الثلاثاء، 9 يوليو 2019

│ নামাজের ঐতিহাসিক গুরুত্ব - ২য় পর্ব │

│ নামাজের ঐতিহাসিক গুরুত্ব - ২য় পর্ব │
১ম পর্বঃ https://tinyurl.com/y25z287f
এরপর একটু রাসূলের জীবনীর দিকে তাকান। তাঁর সমস্ত মিশনের সঙ্গী ছিলেন হযরত খাদিজা (রা) এবং তিনি মৃত্যুবরণ করেন নবুওয়াতের ৯ম বছরে। এটিকে আপনি হয়তো নবুওয়াতের ৯ম বছরের আমুল হুজন বা দুঃখের বছর হিসেবে ইতিহাসে পড়ে থাকবেন। কিন্তু এই পাঠ আর একজন ব্যক্তির ২৫ বছরের দাম্পত্যজীবনের সঙ্গী হারানোর মাঝে বিস্তর ফারাক রয়েছে। এটি কেবল ২৫ বছরের দাম্পত্য জীবন নয়; বরং ২৫ বছরের আত্মিক জীবন, সমস্ত প্রতিকূলতার সময়ের শক্তিশালী সঙ্গীর জীবন। আল্লাহর রাসূলের পাশে যখন কেউ ছিলো না, তিনি ছিলেন ছায়ার মতো; সমস্ত প্রতিকূলতাকে হারিয়েছেন ভালোবাসা দিয়ে, শক্তি দিয়ে, অর্থ দিয়ে। নিজের কাছে রাসূলের অসহায়ত্বকে আগলে রেখে সমস্ত শক্তিটুকু দিয়েছেন ঢেলে। একবার ভাবুন, এই আত্মিক প্রশান্তিকে হারানো, সন্তানদের মা-হারানো মুখগুলোর দিকে তাকানো – এত দীর্ঘ সময়ের আত্মিক জীবনসঙ্গিনীকে হারিয়ে কতোটা কষ্টের গভীরে গিয়েছেন তিনি সেটা ভাষিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলাও অসম্ভব।
বুখারী শরিফের প্রথম অধ্যায় ওহী বিষয়ক। সেখানে যদি আপনি দেখেন আল্লাহর রাসূল জিব্রাইল (আ) এর সাথে প্রথম সাক্ষাতের পর তিনি কাঁপতে কাঁপতে বাড়ি ফিরেছেন। ঘটনা বর্ণনা করেছেন কম্পিত কণ্ঠে। শঙ্কিত হয়েছেন নিজের জীবন ও দায়িত্ব নিয়ে। সে সময়ে খাদিজা (রা) আল্লাহর রাসূলকে শক্তি দিয়েছেন, সাহস যুগিয়েছেন। বলেছেন, আপনি এতিমদের দেখাশুনা করেন, গরীবদের খাবার দেন, অসহায়দের সহায়তা করেন, আর যেই ব্যক্তি এ ভালো কাজগুলো করে তাকে আল্লাহ কখনই ফেলে দিতে পারে না।
তিনি শঙ্কিত হয়েছেন কে আমার আল্লাহর দাওয়াত গ্রহণ করবে? খাদিজা (রা) বলেছেনঃ আমি। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং আপনি আল্লাহর বান্দা ও আল্লাহর রাসূল।
এভাবে ব্যক্তিগত জীবনে এবং নবুওয়াতী বাণীর দাওয়াতে – উভয়ের ব্যাপারে যিনি সর্বাপেক্ষা সহায়তা এবং শক্তি যুগিয়েছেন তিনি চলে গেছেন এই দুনিয়া ছেড়ে, রাসূলকে ছেড়ে। কতোটা কষ্টের মাঝে তিনি পতিত হয়েছেন এটা আমাদের ভাষার ভাবনাকে ছাড়িয়ে যাবে।
এরপর খাদিজার মৃত্যুর ৬ থেকে ৮ মাসের মাথায় মৃত্যুবরণ করেন তাঁর চাচা আবু তালেব। এটাও হয়তো আপনাদের কাছে ইতিহাসের মতো কেবল একটা তারিখ মনে হতে পারে। কিন্তু...কিন্তু এই মৃত্যুও কি স্বাভাবিক ছিলো আল্লাহর রাসূলের জন্য? একবার চিন্তা করুন তো আল্লাহর রাসূলের জীবনের ইতিহাসকে। তাঁর পিতা মৃত্যুবরণ করেন জন্মের পূর্বে। মাতা মৃত্যুবরণ করেন ৬ বছর বয়সে। এরপর দাদা আব্দুল মুত্তালিব লালন-পালনের দায়িত্ব নেন। এরপর? ৮ বছর বয়সে দাদাও মৃত্যুবরণ করেন। এই ৮ বছর বয়স থেকেই চাচা আবু তালেব ছিলেন পিতার মতো। আবু তালেব ছিলেন কুরাইশদের অন্যতম নেতা। কুরাইশদের যেকোনো সভায় তিনি থাকতেন; অভিভাবক হিসেবে এবং সমাজের ভালো-মন্দ বিচারে। এসময় আল্লাহর রাসূল থাকতেন তাঁর কুলে বসে। সেই ছোট্ট সময় থেকেই তো তিনি লালিত হচ্ছেন আবু তালেবের ঘরে; এভাবেই।
আবু তালেবের সন্তানরা কুরাইশদের সামনে কুলে না থাকলেও রাসূল ﷺ থাকতেন। কুরাইশরা এভাবেই দেখে আসছে সেই ছোট্ট সময় থেকে। এমনকি আবু তালেব কোথাও গেলে নিজ সন্তানদের সাথে না নিলেও নবী মুহাম্মাদ ﷺ কে সাথে নিতেন। এতটাই চোখে চোখে আদরের সাথে রাখতেন তাকে। আবু তালেবই ছিলেন আল্লাহর রাসূলের পরিবার! আবু তালেব কখনও আল্লাহর রাসূলকে ছাড়া খাবারও খেতেন না। যদি কখনও তাকে না পেতেন খুঁজে নিয়ে আসতেন, আসলে তখনই খাবার খেতেন। এমনই ভালোবাসা আর পরিবারের ভূমিকায় তিনি ছিলেন।
আবু তালেব ছিলেন নবীর অভিভাবক, কেউ তাকে স্পর্শ করতে পারতো না। কারণ কেউ নবীর কাছে যেতে হলে আবু তালেবকে পেরিয়ে যেতে হতো। সীরাহর কিতাবে এটা স্পষ্ট আছে যে আবু তালেবের মৃত্যুর পর মক্কার যুবকেরা পর্যন্ত তাকে অভিশাপ দিতো, কষ্ট দিতো। অথচ আবু তালেব জীবিত থাকাবস্থায় এ সাহস কখনই ছিলো না। আবু তালেব আল্লাহর রাসূলের এমনই রক্ষাকবচ ছিলেন। এভাবেই আবু তালেবকে হারানো আল্লাহর রাসূলের জন্যে অনেক বড় কষ্টকর ট্রাজেডি ছিলো; বিশেষত খাদিজা (রা) এর মৃত্যুর পিঠাপিঠি এই ঘটনা হওয়ার কারণে কষ্টটা আরো তীব্র হয়ে উঠেছিলো।
আরো একটি বিষয় আমরা সীরাহ থেকে নেই না। আল্লাহর রাসূলের এতো কষ্টগুলো কীভাবে কাটিয়ে উঠেছিলো? আমাদের যুবকরা আল্লাহর রাসূলের এই কষ্টটাকে প্রশমনের দৃষ্টান্ত দেই না যুবকদের। ফলে যুবকরা দাওয়াতী ময়দানে নিজেকেই হারিয়ে ফেলে আল্লাহর দাওয়াত দিতে গিয়ে।
আবু তালেবকে হারানোতে আরো একটা তীব্র কষ্টকর ঘটনা ছিলো তিনি ইসলাম গ্রহণ না করেই দুনিয়া ত্যাগ করেছিলেন। যারা ইসলামে এসেছেন অথচ তাঁদের প্রিয়জন আল্লাহর পথে আসে নি তাঁদের কষ্টটা অন্যরা বুঝতে পারে না। তাঁদের প্রতিদিন এবং দিন শেষে দু’আ হয় তাঁদের প্রিয়জনদের জন্যে; যেন তারা জাহান্নাম থেকে বেঁচে থাকতে পারে। অথচ মৃত্যুর মুহূর্তেও আল্লাহর রাসূল কানে কানে আল্লাহর দিকে আহবান জানিয়েছিলেন; একটিবার আল্লাহর দিকে শাহাদা করার জন্যে। যিনি পিতামাতা এবং দাদার পর এতটাই কাছের ছিলেন, পিতৃতুল্য ছিলেন তিনি আলোহীন অবস্থায় চলে গেলেন, এটা কি যাতনাই না ছিলো রাসূলের জন্যে!
এই ঘটনার ১২ কি ১৩ বছর পর। মক্কা বিজয়ের পর। আবু বকর (রা) তাঁর অতি বৃদ্ধ, অন্ধ পিতা আবু কুহাফাকে আল্লাহর রাসূলের কাছে নিয়ে আসলেন ইসলাম গ্রহণের জন্যে। রাসূল ﷺ দেখে বললেন আমাকে বললে আমি নিজেই তো চলে যেতাম। তিনি ইসলাম গ্রহণ করলেন। আবু বকর (রা) কাঁদতে লাগলেন। আল্লাহর রাসূল ﷺ বললেন, আনন্দের কান্না? আবু বকর (রা) বললেন,
না; বেদনার কান্না। রাসূল ﷺ জিজ্ঞেস করলেন কেন? আবু বকর (রা) বললেন, আমার পিতার পরিবর্তে আবু তালেব যদি ইসলাম গ্রহণ করতো আমি অধিক খুশী হতাম! দেখুন, আবু বকরেরা (রা) সর্বদা আল্লাহর রাসূলের কাছে থাকতেন, তারা ভালো করেই জানতেন আল্লাহর রাসূল কতোটা কষ্ট বুকে ধারণ করতেন আবু তালেবের ইসলামহীন মৃত্যুতে। তারাও যে এত বছর পরে মনে রেখেছে! আবু তালেব তাঁর কাছে কতকিছুই না ছিলো সেই ইসলামের ঊষালগ্নে!
খাদিজা (রা) এর মৃত্যু। আল্লাহর রাসূলে ﷺ আত্মিক জীবনসঙ্গিনীর বিদায়। সন্তানদের মাতৃহারা চাহনি। পিতৃতুল্য চাচার মৃত্যু। দুটি বড় প্রতিরক্ষা ও আশ্রয়স্থলের সমাপ্তি। সমাজের নেতিবাচকতা। কুরাইশদের অনাচার। এতগুলো কষ্টকে তিনি ছাপিয়ে উঠেছিলে কিভাবে জানেন? নামাজের মাধ্যমে। আল্লাহর সান্নিধ্যের মাধ্যমে। আল্লাহর সাথে প্রতিদিনকার কথার মাধ্যমে। সান্ত্বনা, ভবিষ্যতের আশার আলো, অনাগত লোকদের আল্লাহমুখিতা ইত্যাদি নামাজে আল্লাহর সাথে কথাগুলোই প্রশান্তিরূপে বয়ে আসে এবং সমস্ত কষ্টগুলোকে ভুলে গিয়ে তিনি প্রতিদিন নব উদ্যমে আবির্ভূত হন।
দিনের কষ্টগুলোকে রাতের নামাজে ধুয়ে যেতো এবং নব বৃক্ষরূপে পুনরায় শোভিত হয়ে সজীব হয়ে উঠতো। আল্লাহর সাথে আত্মিক সম্পর্কের নামাজ এতটাই গভীর অনুভূতিময়। দুনিয়ার সমস্ত সম্পর্ক নিঃশেষ হয়ে যাক, কিন্তু একটি সম্পর্ক বাকী থাক, আল্লাহর সাথে সম্পর্ক, নামাজ; এটাই যথেষ্ট একজন ব্যক্তির জন্য। আল্লাহ হলো আস-সালাম – সমস্ত প্রশান্তি তিনিই, আমরা সেই আস-সালামের সামনেই নামাজে দাঁড়িয়ে থাকি। সমস্ত প্রশান্তির আধারের সম্মুখে, তাঁর খাজানার দিকে চেয়ে।
এভাবেই আল্লাহ তা’য়ালা রাসূলের সর্বাপেক্ষা কষ্ট ও ট্রাজেডির সময় তাকে তুলে নিলেন আসমানে। আল্লাহর রাসূলকে সমস্ত কষ্টগুলোকে মোচন করার মাধ্যম দিলেন আস-সালাত – নামাজ।
এই উপহার দেওয়ার সময় আল্লাহর রাসূলের নিকটে ওহী নাযিল হলো না বরং আল্লাহই তাকে তুলে নিলেন ওহীর মালিকের কাছ থেকে সরাসরি উপহার নিতে! এভাবেই সালাত আমাদের সাথে আল্লাহর সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যম হয়ে উঠলো। আল্লাহর কালামের সাথে কথা বলা মানেই তো আল্লাহর সাথে কথা বলা। আর সর্বাপেক্ষা প্রিয়র সাথে কথা বলা তো আত্মিক প্রশান্তির জন্য প্রশমন ও আরামদায়ক হবেই। সমস্ত প্রশান্তিদায়ক শক্তির উৎস হবে।
* নেওয়া হয়েছে 'এনএকে বাংলা' থেকে প্রকাশিত মিশরী আল-খারাজের "কীভাবে নামাজের মধুরতা লাভ করা যায়" বই থেকে। এই অধ্যায়ের পুরো লেখাটি আমরা দেবো। এই গুরুত্বপূর্ণ লেখাটি মূলত নেওয়া হয়েছে শাইখ আব্দুন নাসির জাংদার Meaningful Prayer কোর্স থেকে।
বইটি কোথায় পাবেনঃ https://bit.ly/2ZuWD7e
প্রকাশনায়ঃ Bookish Publisher

ليست هناك تعليقات:

إرسال تعليق