কীভাবে করবো বর্ষবরণ?
খালেদ ইবন হুসাইন ইবন আবদুর রহমান
অনুবাদক : সানাউল্লাহ নজির আহমদ
কামাল উদ্দিন মোল্লা
সম্পাদনা : ড. আবু বকর
মুহাম্মাদ যাকারিয়া
كيف نستقبل عاما جديدا؟
(باللغة البنغالية)
خالد بن حسين بن عبدالرحمن
ترجمة:
ثناء الله نذير احمد، كمال الدين ملا
مراجعة: د/ أبو بكر محمد زكريا
সংক্ষিপ্ত বর্ণনা.............
পুরোনো বছর চলে যায়, আসে নতুন বছর। আল্লাহর বিধিত নিয়ম। ইয়াহূদী-নাসারাসহ অনেক অমুসলিম নববর্ষ উদযাপন
করে। তাদের দেখে বহু মুসলিম নববর্ষ উদযাপন করে এ দিনে আনন্দ-ফুর্তিতে মেতে উঠে। হিজরী সাল হলো
মুসলিম উম্মাহর সন। হিজরী সালের আগমনে আমাদের কী করা উচিৎ?
নাকি কোনো কিছু করার বিধান নেই ইসলামী শরী‘আতে?
এ বিষয় বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা করা হয়েছে এ প্রবেন্ধ।
কীভাবে করবো
বর্ষবরণ?
একটি বৎসরের পশ্চাৎপসরণ আরেকটি নতুন বৎসরের
আগমন-সন্ধিক্ষণ আমাদেরকে আত্মপর্যালোচনার আহ্বান জানায়। আবেদন করে
ফলপ্রসু সমালোচনা আর কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহণের। ভবঘুরে উদাসীন ব্যক্তির দিনগুলো
নিষ্ফল, আফসোস নির্মম-নিত্য সঙ্গী। কারণ, স্বীয় জীবনই যার জন্য কাল, প্রতিটি মুহূর্ত যাকে
পদস্খলন আর অধঃপতনের দিকে তাড়িত করে, তার চেয়ে অধিক হতভাগা আর কে? মনে রাখতে হবে,
মাস-বৎসরের উত্থান-পতন প্রকৃত দীক্ষার গুরু, যুগের আবর্তন-বিবর্তন সশব্দ উপদেশ বাণী।
সুতরাং এর দীক্ষা গ্রহণ করো, এর উপদেশ শ্রবণ করো। জনৈক খ্যাতনামা আলেমের আপ্তবাক্য, ‘চারটি বস্তু ভাগ্যাহত আর বিঢ়ম্বনার
নিদর্শন, চোখের শুষ্কতা, অন্তরের কাঠিন্য, লম্বা লম্বা আশা আর দুনিয়ার প্রতি অতি
আগ্রহ।’
প্রিয় পাঠক!
দুনিয়ার প্রতি দূরদৃষ্টি প্রদানকারী আত্মবিশ্বাস নিয়ে সহসা বলবে, এর নি‘আমত পরীক্ষার বস্তু, এতে জীবিকা
নির্বাহ বিরক্তিকর, কল্যাণ সীমিত ও সংকোচিত, এর জীবন যন্ত্রণাদায়ক, এর নিষ্কলুষতা
নোংরামি, নতুন পুরাতন উন্মুখ, রাজত্ব ক্ষয়িষ্ণু, মহব্বত ক্ষণস্থায়ী, এতে নিমজ্জিত ব্যক্তি শঙ্কিত ও আতঙ্কিত।
দুনিয়া হয়তো ধ্বংসশীল নি‘আমত, আসন্ন মুসিবত কিংবা সবার ওপর নিশ্চিত
সিদ্ধান্ত-মৃত্যু।
﴿يَٰقَوۡمِ إِنَّمَا
هَٰذِهِ ٱلۡحَيَوٰةُ ٱلدُّنۡيَا مَتَٰعٞ وَإِنَّ ٱلۡأٓخِرَةَ هِيَ دَارُ ٱلۡقَرَارِ
٣٩﴾ [غافر: ٣٩]
“হে আমার সম্প্রদায়!
এ দুনিয়া কিন্তু সামান্য উপভোগ সামগ্রী মাত্র, পক্ষান্তরে আখেরাত
চিরস্থায়ী-অনন্ত।” [সুরা গাফির, আয়াত: ৩৯]
প্রিয় পাঠক! আপনি কখনো মৃত্যুর বিভীষিকা তার
যাতনা, কষ্ট আর ভয়াবহতা চিন্তা করেছেন? ভেবেছেন, কত যন্ত্রণার ওপর দিয়ে আপনার
আত্মা দেহ ত্যাগ করবে? কেউ বলেছেন: মৃত্যু তলোয়ারের আঘাত, করাতের চিরুনী এবং
কেঁচির কর্তন হতেও অসহ্য বেদনা। চিন্তা করো- হে মৃত্যুর ভোগান্তি হতে উদাসীন! মৃত্যু চিরন্তন,
মৃত্যু নিরপেক্ষ। মৃত্যু কাউকে ভয় করে না, কাউকে দেখে সে পিছপা হয় না, কারো জন্য
তার দয়া-মায়া হয় না। অতএব, আত্মোন্নতি আর আত্মশুদ্ধির জন্য নিজেকে প্রস্তুত করো আর বল:
ও আমার মন, ঘনিয়ে
এসেছে বিদায় বেলা,
উঁকি দিয়েছে,
কঠিন মুত্যৃর অধ্যাদেশ,
তৈরি হও, প্রস্তুতি নাও আর খেলনা
নয়,
বড় বড় আশা আর
বৃহৎ পরিকল্পনায়।
মৃত্যু তোমায়
উপনীত করবে এমন জায়গায়,
ভুলে যাবে সেখানে
অকৃত্রিম বন্ধু সব প্রায়।
মাটির স্তুপ রেখে দিবে
তোমরা উপর,
মণের পর মণ, যার
সামর্থ নেই তোমার।
মৃত্যু আমাদের
সকলের সঙ্গী,
ধনী বা গরীব কেউ রবে না
বাকি।
প্রিয় পাঠক! চিন্তা করেছেন, কবর এবং তার
ভেতরের অন্ধকার? সংকীর্ণতা এবং তার নির্মমতা? পিষ্ট হবে তার যাতাকলে, উত্তম-অধম,
রাজা-প্রজা, সৎ-অসৎ, নেককার-বদকার, শাসক-শাসিত সকলেই। হয়তো সে জান্নাতের একটি বাগান কিংবা
জাহান্নামের একটি গর্ত।
প্রিয় পাঠক! মনে করুন,
আর মাত্র তিন দিন পর আপনি কবর যাত্রী, আপনার পরিধেয় বস্ত্র খোলা হলো, আপনাকে মাটির
স্তুপ দিয়ে ঢেকে দেওয়া হলো। আত্মীয়-স্বজন ত্যাগ করছেন, বন্ধ-বান্ধব বিদায় জানাচ্ছেন, আপনার
সান্ত্বনার নেই কোনো সতীর্থ, সহপাঠি, শুধু কৃতকর্ম ছাড়া। সুতরাং আপনি আগত ভবিষ্যতের সঞ্চয়
হিসেবে কী পছন্দ করছেন? যা আপনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করবে, কখন সমাহিত হচ্ছেন কবরে।
﴿يَوۡمَ تَجِدُ كُلُّ
نَفۡسٖ مَّا عَمِلَتۡ مِنۡ خَيۡرٖ مُّحۡضَرٗا وَمَا عَمِلَتۡ مِن سُوٓءٖ تَوَدُّ لَوۡ
أَنَّ بَيۡنَهَا وَبَيۡنَهُۥٓ أَمَدَۢا بَعِيدٗاۗ وَيُحَذِّرُكُمُ ٱللَّهُ نَفۡسَهُۥۗ
وَٱللَّهُ رَءُوفُۢ بِٱلۡعِبَادِ ٣٠﴾ [ال عمران: ٣٠]
“সেদিন প্রত্যেক ব্যক্তি
স্বীয় কৃত ভালো-মন্দ পুঙ্খানুপুঙ্খ প্রত্যক্ষ করবে। বিলাপ করবে, হায়! এ কৃতকর্মের সাথে যদি
আমার কোনো সম্পর্ক না থাকতো। আল্লাহ স্বীয় সত্তা থেকে তোমাদেরকে সতর্ক
করছেন। আল্লাহ বান্দাদের প্রতি মেহেরবান-দয়াশীল।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৩০]
কবি সত্যিই বলেছেন,
আল্লাহর শপথ! যদি
কোনো যুবক জীবিত থাকে,
হাজার বৎসর,
সুস্থ সবল আর নিজের সামর্থ নিয়ে,
প্রতিটি স্বাদই উপভোগ করে,
আভিজাত আবাসনে
বসবাস করে,
কষ্ট দেখা দেয় নি জীবনে যার,
অন্তরে চিন্তার
অনুপ্রবেশ ঘটে নি তার.
হবে না সমান আরো
সুখি হলে,
এক রাত-কবরের কষ্টের মুখে।
প্রিয় বন্ধু! কখনো ভেবেছো, কবরের প্রথম
রাত্রির কথা। সেখানে নেই কোনো সান্ত্বনা, সতীর্থ, বন্ধু, স্ত্রী, সন্তান, আত্মীয়-স্বজন,
﴿ثُمَّ رُدُّوٓاْ إِلَى ٱللَّهِ مَوۡلَىٰهُمُ ٱلۡحَقِّۚ أَلَا لَهُ ٱلۡحُكۡمُ
وَهُوَ أَسۡرَعُ ٱلۡحَٰسِبِينَ ٦٢﴾ [الانعام: ٦٢]
“অতঃপর তাকে উপনীত করা হবে, তাদের প্রভু-আল্লাহ তা‘আলার নিকট। স্মরণ
রেখো! তার সিদ্ধান্তই একমাত্র সিদ্ধান্ত। তিনি সবচেয়ে দ্রুত হিসাব নিরসনকারী।” [সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ৬২]
আমার গোরস্থানে হয়েছে একদিন
অতিক্রান্ত
সব সুখ আমার সেখানেই
সর্বশান্ত।
কবরের ভয়ানক
প্রথম রাত,
আল্লাহর শপথ! বল, কী তার
জিজ্ঞাসাবাদ?
প্রিয় পাঠক!
চিন্তা করেছেন, ইসরাফীলের শিঙ্গায় ফুঁক? পুনরুত্থান দিবসের উপস্থিতি? আমলনামার ছুটাছুটি?
আল্লাহর সমীপে দণ্ডায়মান? কম-বেশি, ছোট-বড়, ক্ষুদ্র-বৃহৎ সব কিছুর যেখানে হিসাব গ্রহণ করা হবে। মীযান তথা পরিমাপ
যন্ত্র স্থাপন করা হবে, আমল মাপার জন্য। পুলসিরাত অতিক্রম অতঃপর
অপেক্ষা আর অপেক্ষা প্রহর, হয়তো ভাগ্যবান কিংবা হতভাগা বলে আহ্বান।
﴿فَرِيقٞ فِي ٱلۡجَنَّةِ
وَفَرِيقٞ فِي ٱلسَّعِيرِ﴾ [الشورا: ٧]
“এক দল জান্নাতী,
অপর দল জাহান্নামী।” [সূরা আশ-শূরা, আয়াত: ৭]
﴿فَأَمَّا ٱلَّذِينَ
شَقُواْ فَفِي ٱلنَّارِ لَهُمۡ فِيهَا زَفِيرٞ وَشَهِيقٌ ١٠٦ خَٰلِدِينَ فِيهَا مَا
دَامَتِ ٱلسَّمَٰوَٰتُ وَٱلۡأَرۡضُ إِلَّا مَا شَآءَ رَبُّكَۚ إِنَّ رَبَّكَ فَعَّالٞ
لِّمَا يُرِيدُ ١٠٧ ۞وَأَمَّا ٱلَّذِينَ سُعِدُواْ فَفِي ٱلۡجَنَّةِ خَٰلِدِينَ فِيهَا
مَا دَامَتِ ٱلسَّمَٰوَٰتُ وَٱلۡأَرۡضُ إِلَّا مَا شَآءَ رَبُّكَۖ عَطَآءً غَيۡرَ
مَجۡذُوذٖ ١٠٨﴾ [هود: ١٠٦، ١٠٨]
“যারা হতভাগ্য
তারা জাহান্নামে যাবে- সেখানে তারা আর্তনাদ ও চিৎকার করতে থাকবে। আসমান-জমিনের
স্থায়ীকাল পর্যন্ত তারা সেখানে থাকবে। তবে তোমার প্রভূ অন্য কিছু ইচ্ছে করলে,
ভিন্ন কথা। নিশ্চয় তোমার প্রভু যা ইচ্ছে তা বাস্তবায়ন করতে পারেন। আর যারা
ভাগ্যবান, তারা জান্নাতে যাবে, সেখানে তারা আসমান-জমিনের স্থায়ীকাল পর্যন্ত
অবস্থান করবে। তবে তোমার প্রভু অন্য কিছু ইচ্ছে করলে ভিন্ন কথা, এ দানের ধারাবাহিকতা
কখনো ছিন্ন হওয়ার নয়।” [সুরা হূদ, আয়াত: ১০৬-১০৮]
হে আমার ভাই, কোন
দলের হতে চাও তুমি? মনে রাখবে, উপদেশ গ্রহণের জন্য এতটুকুই যতেষ্ট : মৃত্যুর কাছে
তুমি নিশ্চিত পরাভূত, মাটি তোমার বিছানা, কবর তোমার আস্তানা, ভূ-গর্ভ তোমার শয্যা,
কিয়ামত তোমার
সর্বশেষ ঠিকানা। হয়তো জান্নাত, নয়তো জাহান্নাম। তার পরেও কি চিন্তা করবে না?
প্রস্তুতি নিবে না তার জন্য?
প্রিয় পাঠক! এ
জীবন সংক্ষিপ্ত, সফর লম্বা, সম্বল অপ্রতুল। মানুষের দু’টি অবস্থা: একটি অতীত
কর্ম, যার ব্যাপারে আল্লাহর ফয়সালা জানা নেই। আরেকটি সামনের ভবিষ্যত, যার ব্যাপারে
আল্লাহর সিদ্ধান্ত জানা নেই। সুতরাং বুদ্ধিমান ব্যক্তির উচিৎ, জীবন থাকতে জীবনের
জন্য, প্রাণ থাকতে মৃত্যুর জন্য, যৌবন থাকতে বার্ধক্যের জন্য, সুস্থ্যতা থাকতে অসুস্থ্যতার
জন্য, অবসরতা থাকতে ব্যস্ততার জন্য, সচ্ছলতা থাকতে অসচ্ছলতার জন্য, সামর্থ থাকতে
সামর্থহীনতার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া। মৃত্যুর পর কোনো তাওবার সুযোগ নেই। দুনিয়ার
পর তৃতীয় কোনো স্থান নেই: হয়তো জান্নাত, নয়তো জাহান্নাম।
﴿فَأَمَّا مَن ثَقُلَتۡ
مَوَٰزِينُهُۥ ٦ فَهُوَ فِي عِيشَةٖ رَّاضِيَةٖ ٧ وَأَمَّا مَنۡ خَفَّتۡ مَوَٰزِينُهُۥ
٨ فَأُمُّهُۥ هَاوِيَةٞ ٩ وَمَآ أَدۡرَىٰكَ مَا هِيَهۡ ١٠ نَارٌ حَامِيَةُۢ ١١﴾ [القارعة: ٦، ١١]
“অতএব, যার আমলের
পাল্লা ভারি হবে, সে সন্তোষজনক বাসস্থানে যাবে, আর যার আমলনামা হালকা হবে, তার
স্থান হাওয়ীয়াহ। তুমি জানো হাওয়ীয়াহ কী? হাওয়ীয়াহ হলো, জ্বলন্ত আগুন।” [সূরা আল-কারি‘আহ, আয়াত: ৬-১১] যে স্বীয়
সম্পর্ক আল্লাহর সাথে ভালো রাখবে, আল্লাহ তার সম্পর্ক মানুষের সাথে ভালো করে
দিবেন। যার আভ্যন্তরীন সুন্দর হবে, তার বাহ্যিক অবস্থাও ভালো হবে। যে আখেরাতের
জন্য আমল করবে, আল্লাহ তার দুনিয়ার সকল সমস্যার সমাধান করে দিবেন। অতএব, হিজরি সনের
প্রারম্ভে আমাদের সকলকে নতুন প্রত্যয়, নব উদ্দমে অঙ্গিকার করা প্রয়োজন, যা আমাদের
নেককাজ করতে উদ্বুদ্ধ করবে এবং কিয়ামতের দিন আল্লাহর সামনে উপস্থিত হওয়ার কাজ সহজ করে
দিবে।
আব্দুল্লাহ ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম আমার ঘাড় ধরে বলেন,
«كُنْ فِي الدُّنْيَا
كَأَنَّكَ غَرِيبٌ أَوْ عَابِرُ سَبِيلٍ» وَكَانَ ابْنُ عُمَرَ، يَقُولُ: «إِذَا
أَمْسَيْتَ فَلاَ تَنْتَظِرِ الصَّبَاحَ، وَإِذَا أَصْبَحْتَ
فَلاَ تَنْتَظِرِ المَسَاءَ، وَخُذْ مِنْ صِحَّتِكَ لِمَرَضِكَ، وَمِنْ حَيَاتِكَ
لِمَوْتِكَ»
“দুনিয়াতে তুমি
ভিনদেশী লোক কিংবা একজন মুসাফিরের ন্যায় জীবনযাপন করো।’ ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলতেন, ‘যখন
তুমি প্রত্যুষ যাপন করো, সন্ধ্যার অপেক্ষা করো না। সন্ধ্যায় উপনীত হলে, প্রত্যুষের
আশা রেখো না। তোমার সুস্থ্যতা থাকতে অসুস্থ্যতার জন্য এবং জীবন থাকতে মুত্যুর জন্য
সঞ্চয় করো।” (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬৪১৬)
নিজের পরিণাম সম্পর্কে ‘ও
অবচেতন’! অপরাধ সত্ত্বেও উদ্যোগহীন! তোমার চেয়ে বড় বড় ব্যক্তিরাও মৃত্যুর ওপারে চলে গেছে,
তুমি এখনও অবচেতন? তাওবা করো-অনুশোচনা নিয়ে, অবনত মস্তক হও দীনতাসহ। আর আবৃতি করো: ‘আমি
অপরাধী, রাতের শেষ ভাগে ক্ষমা চাচ্ছি। আমি অপরাধী, আল্লাহ তুমি মেহেরবান। ভালো
লোকদের সাদৃশ্য গ্রহণ করো, যদিও তুমি তাদের কেউ নও, চোখের অশ্রু নির্গত করো,
অন্ধকারে আল্লাহকে আহ্বান করো। কায়মনোবাক্য তাওবা করো। বাকি জীবন লুফে
নাও, গান-বাদ্য পরিত্যাগ করো, দুনিয়ার অতিমগ্নতা, গুনাহ-অপরাধ ইত্যাদি চিরতরে
ত্যাগ করো, যদি তুমি সফল হতে চাও।
প্রিয় পাঠক! তুমি
নিজেকে নিয়ে একাকি বসো। বিগত বৎসরে যে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে তার সামান্য হিসাব কষে
নাও। ভবিষ্যতের জন্য ঐ সকল অপরাধ চিরতরে ছেড়ে দাও, এর বিপরীতে তোমাকে পরিপাটি ও
সৌন্দর্যমণ্ডিত করে এমন সব আমল দ্বারা নিজেকে সজ্জিত করো। সূচনা করো আল্লাহর সাথে নতুন
এক অধ্যায়ের। আশা করি, আল্লাহ তোমার পদস্খলনগুলো মাফ করে দিবেন।
আত্মপর্যালোচনা
দু‘ প্রকার: এক প্রকার কাজের আগে, অপর প্রকার কাজের পরে।
প্রথম প্রকার: বান্দা তার অভিপ্রায়
এবং ইচ্ছার শুরুতেই থামবে, কাজে তাড়াহুড়ো করবে না, যেন তার নিকট পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে, এ কাজ সে
অব্যাহত রাখবে নাকি পরিহার করবে।
হাসান বসরী রহ. বলেন, ‘আল্লাহ ঐ
ব্যক্তির ওপর অনুগ্রহ করুন, যে তার অভিপ্রায়ের সময় থামে, অতঃপর যদি আল্লাহর জন্য হয়ে
থাকে সে অগ্রসর হয়, আর যদি অন্যের জন্য হয় সে পরিহার করে।’
দ্বিতীয় প্রকার: কাজের পর আত্মপর্যালোচনা, এটা তিন
প্রকার:
প্রথম প্রকার: আনুগত্য নিয়ে
আত্মসমালোচনা। আনুগত্যে আল্লাহর অধিকারে ত্রুটি হলে যথাযথ আনুগত্য হয় নি। আনুগত্যে
আল্লাহর অধিকার ছয়টি, তাহলো:
1. ইখলাস।
2. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুকরণ।
3. সদুপদেশ আল্লাহর জন্য হওয়া।
4. আনুগত্যে অনুগ্রহের দৃশ্য উপস্থিত থাকা।
5. আনুগত্যের তাওফীক হাসিলে আপনার ওপর
আল্লাহর অনুগ্রহের কথা বিবেচনায় থাকা।
6. আনুগত্যে আপন অক্ষমতাকে প্রত্যক্ষ করা।
বান্দা আত্মপর্যালোচনা করবে, সে যে
আনুগত্য করছে, এর মধ্যে আনুগত্যের ঐ সকল স্তর উপস্থিত আছে কি? নেই।
দ্বিতীয় প্রকার: আত্মপর্যালোচনা করা ঐ সকল
কাজে যা পরিহার করা উত্তম ছিল।
তৃতীয় প্রকার: বৈধ অথবা অভ্যাসগত কোনো কাজ কেন সে করল
এর জন্য আত্মসমালোচনা করা, এতে কি আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং পরকাল উদ্দেশ্য? তাহলে তা
হবে লাভজনক, নাকি দুনিয়ায় নগদ উপার্জন উদ্দেশ্য? তাহলে কল্যাণ ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং
এ কাজের সফলতা অর্জিত হবে না।
ইমাম ইবনুল কাইয়্যেম রহ. আত্মসমালোচনার যে
পদ্ধতি বর্ননা করেছেন তা এই-
1. ফরযসমূহ দিয়ে কাজ শুরু করবে, যদি তাতে কোনো ত্রুটি দেখ সংশোধন করবে।
2. অতঃপর নিষিদ্ধ কাজসমূহ, যখন সে জানতে পারবে কোনো নিষিদ্ধ কাজে সে জড়িত
হয়েছে তাহলে তাওবা ইস্তেগফার এবং গোনাহ মোচনীয় নেককাজের মাধ্যমে সংশোধন করে নিবে।
3. অবহেলার জন্য আত্মসমালোচনা করা এবং এর প্রতিকার করা আল্লাহর দিকে মনোযোগ দেওয়া, আল্লাহকে স্মরণ
করা।
4. অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ব্যবহার- কথা বলা, চলাফেরা,
হাতের ব্যবহার, চোখের দৃষ্টি, কানের শ্রবণ ইত্যাদি ব্যবহারের ওপর আত্মসমালোচনা
করা, এগুলোর ব্যবহার দ্বারা আপনার উদ্দেশ্য কী ছিল? কার জন্যে করেছেন?
কোন পদ্ধতিতে করেছেন?.
প্রিয় ভাই! আত্মসমালোচনা কঠিন কাজ, তবে আল্লাহ
যার জন্যে সহজ করেন। কতিপয় বস্তু আছে যা বান্দার আত্মোসমালোচনায় সহায়ক। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য
কয়েকটি হলো-
1. এটা উপলব্ধি করা যে, বান্দা আল্লাহর নিরীক্ষণে আছে এবং আল্লাহ তার ভুল-ত্রুটি
সম্পর্কে অবগত, বান্দা যখন তা জানবে, তখন সে মনোযোগী হবে, নিদ্রা থেকে জাগবে এবং
আত্মোসমালোচনায় তার ইচ্ছা ও প্রচেষ্টা শক্তিশালী হবে।
2. বান্দার জানা থাকা যে, আত্মোসমালোচনায় আজকে পরিশ্রম করা মানে আগামী কাল আরাম
লাভ, আর আজকে অবহেলা মানে আগামী কালের হিসাব জটিল করা।
3. কিয়ামত দিবসে পরাক্রমশীল আল্লাহর সম্মুখে প্রশ্ন এবং মহা হিসাবকে স্মরণ
করা, যখন সে জানবে আল্লাহর সামনে জাওয়াব দিতে হবে, তখন সে প্রস্তুত করবে প্রত্যেক
প্রশ্নের উত্তর। এতে করে বান্দা আত্মসমালোচনায় যত্নবান হবে।
4. বান্দা কর্তৃক আত্মসমালোচনার উপকারিতা জানা এবং তা পর্যবেক্ষণ করা, উপকারিতাগুলো হলো
জানাতুল ফিরদাউসে অবস্থান, আল্লাহর পবিত্র দীদার লাভ, নবী, নেককার
এবং উচ্চমর্যদাশালীগণের সঙ্গলাভ; আর আত্মসমালোচনা না থাকলে এসব কিছু সে খোয়াবে, হারাবে এবং
এগুলো হারানোর মতো আর কোনো বড় লোকসান কিছু হতে পারে না।
5. আত্মসমালোচনা পরিহারের ক্ষতির দিকে দৃষ্টি রাখা, যা হলো ধ্বংস, বরবাদি,
আগুনে প্রবেশ, আল্লাহর দীদার লাভে প্রতিবন্ধকতা, কাফের, গোমরাহ, অপবিত্র শ্রেণির সঙ্গ হওয়া।
6. ভালো মানুষের সাহচর্য গ্রহণ, যারা আত্মসমালোচনা করে এবং নিজের দোষ-ত্রুটি অনুসন্ধান
করে এবং বিপরীত শ্রেণির সাহচর্য পরিহার করা।
7. সীরাতে মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবায়ে কেরামের জীবনীতে দৃষ্টি
দেওয়া, আমাদের সালফে সালেহীনদের মাঝে যারা আত্মপর্যালোচনা, আত্ম
পর্যবেক্ষণ করতেন তাদের জীবনী জানা।
8. কবর যিয়ারত করা এবং মৃতদের মধ্যে যারা আত্মসমালোচনা করে নি তাদের অবস্থা
চিন্তা করা, অথবা তাদের হাতছাড়া হয়ে যাওয়া নি‘আমতসমূহ অনুভব করা।
9. আলেম ওলামাদের মজলিসে, ওয়াজ মাহফিলে উপস্থিত হওয়া। কারণ, এটা আত্মসমালোচনায়
সহায়ক।
10. কিয়ামুললাইল, চিন্তা, একাগ্রতার মাধ্যমে কুরআন পাঠ এবং নানা প্রকার ইবাদতের মাধ্যমে
আল্লাহর নৈকট্য অর্জন।
11. প্রমোদ, গাফলতি এবং অশ্লীলতার স্থানগুলো পরিহার করা। কারণ, এগুলো মানুষকে
মুহাসাবাতুন্নাফস বা আত্মপর্যালোচনা ভুলিয়ে দেয়।
12. আল্লাহর স্মরণ করা, প্রার্থনা করা, যেন তিনি আপনাকে মুহাসিবীন ও মুরাকিবীনদের অন্তর্ভুক্ত করেন।
13. নিজের ওপর খারাপ ধারণা পোষণ করা, কারণ যে নিজের ওপর ভালো ধারণা করে সে
আত্মসমালোচনা ভুলে যায় অথবা একে উপেক্ষা করে, কখনোও বা নিজের ওপর ভালো ধারণার ফলে মনে
করে তার গুনাহ ও নেকী সমান, এটা তাকে আত্মসমালোচনা না করার দিকে আহ্বান করে থাকে।
প্রিয় বন্ধু! উল্লিখিত বস্তুগুলোতে যে
গুরুত্ব দিবে সে আল্লাহর ফযলে মুহাসাবাতুন্নাফসের ফল উপভোগ করবে দুনিয়া অথবা পরকালে।
মহাসাবাতুন্নাফসে অনেক লাভ যা নিম্নে উদাহারণস্বরূপ কয়েকটি বর্ণিত হলো:
1. আত্মার অপরাধ ও ক্ষতি সম্পর্কে অবগত হওয়া, বস্তুত যে আত্মার অপরাধ সম্পর্কে অবগত নয় তার
পক্ষে এগুলো অপসারণ করা সম্ভব নয়।
2. তাওবা করা, লজ্জিত হওয়া, উপযুক্ত সময়ে হারানো বস্তু বিষয় উপলব্ধি হওয়া।
3. আল্লাহর অধিকার জানা, কারণ মুহাসাবার মূল হলো আল্লাহর অধিকার আদায়ে শৈথিল্য
প্রদর্শনে হিসাব-নিকাশ করা।
4. আল্লাহর কাছে নত হওয়া।
5. বান্দার ওপর আল্লাহর অনুগ্রহ, দয়া এবং ক্ষমা সম্পর্কে জানা, বান্দা এতো এতো গুনাহ এবং বিরোধিতা করার পরও
আল্লাহ তার জন্য তড়িৎ কোনো ব্যবস্থা নেন নি।
6. আত্মাকে ঘৃণা করা, দোষারোপ করা এবং অহংকার, লৌকিকতা থেকে মুক্তি লাভ।
7. ইবাদত বন্দেগিতে অধিক মেহনত করা, গুনাহ পরিত্যাগ করা যেন মুহাসাবাহ করা সহজ
হয়।
8. অপরের হক ফেরৎ দান, বিদ্বেষ ভুলে যাওয়া, উত্তম আচরণ করা, এগুলো হলো বড় মুহাসাবাহ।
প্রিয় ভাই! বুদ্ধিমান এবং আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাসীর উচিৎ
আত্মসমালোচনায় সে অবহেলা করবে না এবং আত্মার সকল নড়াচড়া, চলাফেরা, অবস্থান, পদক্ষেপকে দাবিয়ে রাখা। জীবনের প্রতিটি
শ্বাস-প্রশ্বাস একেকটি মূল্যবান হিরকখণ্ড তুল্য, এর মাধ্যমে ধনভাণ্ডার ক্রয় করা যায়, যার নি‘আমত কখনো শেষ হওয়ার নয়। এ মূল্যবান বস্তুকে নষ্ট করা অথবা
এর মাধ্যমে এমন বস্তু ক্রয় করা যা মহা ধ্বংসকে ডেকে আনে এটা শুধু মুর্খ-নির্বোধ করে
থাকবে, তার এ মহা ক্ষতির হাকীকত প্রকাশ পাবে কিয়ামত দিবসে।
“সে দিন প্রত্যেক ব্যক্তি সৎকর্ম হতে যা করেছে তা মজুদ
পাবে এবং সে যে মন্দ করেছে তাও পাবে। তখন সে ইচ্ছা করবে যে, যদি তার মধ্যে ও ঐ দুষ্কর্মের
মধ্যে সুদূর ব্যবধান হতো এবং আল্লাহ তা‘আলা তোমাদেরকে স্বীয় পবিত্র অস্তিত্বের ভয় প্রদর্শন
করেছেন এবং আল্লাহ স্বীয় বান্দাদের প্রতি স্নেহশীল।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৩০]
এ ঈমানী শক্তি এবং সজিবাত্মা নিয়েই আমরা নতুন হিজরি
সালকে স্বাগত জানাব। আমরা সকলেই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হারানো বস্তুর প্রতিকারে এবং
সকল অবস্থায় আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে কাজ করার।
দুরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক আমাদের নবীর ওপর এবং আহলে বাইত
ও সাহাবায়ে কেরামের ওপর।
ليست هناك تعليقات:
إرسال تعليق